রংপুরের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের ঐতিহাসিক ঘটনা আজও ভোলেননি ভাষা সৈনিক ও প্রবীণ রাজনীতিক মোহাম্মদ আফজাল

- আপডেট সময় : ১০:২৮:৫২ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২০ ফেব্রুয়ারী ২০২৫ ৫৬ বার পড়া হয়েছে

স্টাফ রিপোর্টার রংপুর
রংপুরের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের ঐতিহাসিক ঘটনা আজও ভোলেননি ভাষা সৈনিক ও প্রবীণ রাজনীতিক মোহাম্মদ আফজাল। ভাষা আন্দোলনের চার বছর পর ১৯৫৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে রংপুরে নির্মিত হয় এই শহীদ মিনার। এটি সারাদেশে তৃতীয় শহীদ মিনার হিসেবে ইতিহাসে স্থান পেয়েছে। ঢাকা ও রাজশাহীর পর রংপুরেই নির্মিত হয় এই স্মৃতিস্তম্ভ।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর রাজশাহী কলেজে প্রথম শহীদ মিনার নির্মিত হয় ২১ ফেব্রুয়ারি রাতেই। এর দুই দিন পর ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা ঢাকার প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণ করেন। এর চার বছর পর রংপুরের ভাষা সৈনিকরা তাদের সাহসী উদ্যোগে গড়ে তোলেন এই শহীদ মিনার।
১৯৫৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে রংপুর পাবলিক লাইব্রেরি মাঠের মাঝখানে ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত হয় এই শহীদ মিনার। ভাষা আন্দোলনের বীর শহীদদের স্মরণে রাতের অন্ধকারে ইট, বালু, কাঁদামাটি ও সিমেন্ট সংগ্রহ করে ছাত্র নেতারা নিজেরাই গড়ে তোলেন এই স্মৃতিস্তম্ভ। পাবলিক লাইব্রেরি ভবনের হলরুমের সামনে ছোট আকারে মাথা তুলে দাঁড়ায় রংপুরের প্রথম শহীদ মিনার।
ভাষা সৈনিক মোহাম্মদ আফজাল জানান, ১৯৫৬ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ভাষা সৈনিক তবিবর রহমানের বাড়িতে শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্দেশ্যে এক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে উপস্থিত ছিলেন আমিনুল ইসলাম, খয়রুল ইসলাম, নজমুল আলম হেবিন, জেবিন, গোলাম রব্বানী বুলবুল, মকসুদার রহমান, সুফী মোতাহার হোসেন, মীর আনিছুল হক পেয়ারা সহ অনেকেই । সভায় ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্রলীগ ও যুবলীগের যৌথ কমিটি গঠন করে রাতেই শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
সেদিন রাতে রংপুর শহরের গুপ্তপাড়া নিউ ক্রস রোডের ডাক্তার মোজাহার হোসেনের বাড়ির সামনে থেকে কিছু ইট সংগ্রহ করা হয়। এছাড়াও বিভিন্ন স্থান থেকে ইট ও সিমেন্ট সংগ্রহ করা হয়। সিমেন্টের অভাবে তৎকালীন রংপুর পৌরসভার পুকুরের কাঁদামাটি ব্যবহার করা হয়। এভাবেই রাতের অন্ধকারে নির্মিত হয় রংপুরের প্রথম শহীদ মিনার।
পরদিন সকালে শহীদ মিনার নির্মাণের খবর ছড়িয়ে পড়লে পাবলিক লাইব্রেরি মাঠে রংপুরের ছাত্র-জনতার ব্যাপক জমায়েত হয়। ভোরবেলা অস্থায়ী শহীদ মিনারে ফুলে ফুলে ভরে যায়। সবাই ভাষা শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং অধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে শপথ নেন। পরবর্তীতে রংপুরের নেতৃস্থানীয় রাজনীতিকদের উদ্যোগে ইটের গাঁথুনি দিয়ে একটি স্থায়ী শহীদ মিনার নির্মিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগ পর্যন্ত এটি রংপুরের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এই শহীদ মিনার গুঁড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৭ সালে রংপুর পৌর পরিষদ পূর্ণাঙ্গ শহীদ মিনার নির্মাণের উদ্যোগ নেয়। দেশের প্রখ্যাত স্থপতি রংপুরের পীরগঞ্জের টিআইএম নুরুন্নবী চৌধুরী (তাজু চৌধুরী) এর স্থাপত্য নকশা ও তত্ত্বাবধানে ১৯৮০ সালে বর্তমান শহীদ মিনারটির নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়।
১৯৮০ সাল থেকে প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারিসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসে রংপুরের সর্বস্তরের মানুষ এই শহীদ মিনারে ভাষা শহীদদের স্মরণে শ্রদ্ধা নিবেদন করে আসছে। এছাড়াও রংপুরের সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড এই পাবলিক লাইব্রেরি মাঠ ও শহীদ মিনার চত্বরকে কেন্দ্র করে পরিচালিত হয়। রংপুরের প্রথম শহীদ মিনার নির্মাণের এই সাহসী অধ্যায় আজও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে এক গৌরবময় স্মৃতি হিসেবে স্মরণীয় হয়ে আছে।