ঢাকা ১০:৪৬ অপরাহ্ন, শনিবার, ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৩ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম ::
দেশি-বিদেশি সুগভীর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে অবৈধ পন্থায় শেখ হাসিনা সরকারকে হটিয়েছে : নানক রংপুরে বিএনপির নাম ভাঙিয়ে চাঁদাবাজি রুখতে দলীয় অভিযোগ সেল গঠন পাকিস্তানকে হোয়াইটওয়াশ করায় রাষ্ট্রপতির অভিনন্দন এ দেশে মসজিদের মতো মন্দিরও পাহারা দিতে হবে না জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত লড়াই করতে হবে-জানে আলম খোকা লালপুরে প্রবাসীর স্ত্রী ও ছেলেকে মারপিটের ঘটনায় সংবাদ সম্মেলন ঝালকাঠির রাজাপুরে স্কুল ছাত্রীর মৃত্যুর ঘটনায় জড়িতদের বিচারের দাবিতে মায়ের সংবাদ সম্মেলন জনতার পুলিশ গঠনে সহযোগিতা চাইলেন এসপি বাস ট্রাকের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ৫ আহত ২০ বিএনপির ৪৬তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী আজ

রাঙ্গুনিয়ায় অবশিষ্ট ঐতিহ্যবাহী ভ্রমণবাহন ‘পালকি’

মুবিন বিন সোলাইমান, চট্টগ্রাম:
  • আপডেট সময় : ০৫:৩৪:১৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৩ ১৮২ বার পড়া হয়েছে
দৈনিক যখন সময় অনলাইনের সর্বশেষ নিউজ পেতে অনুসরণ করুন গুগল নিউজ (Google News) ফিডটি

মুবিন বিন সোলাইমান চট্টগ্রাম:
কালপরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যের ভ্রমণবাহন ‘পালকি’। রঙিন ঝালর দেয়া আর নানা রঙের ফুল ও কাগজে সাজানো পালকির ভেতর ঘোমটা দেয়া বধূর মুখখানি দেখতে আশপাশের মানুষ এসে দাঁড়ায় রাস্তার পাশে। এখন আর সেই আবিষ্ট করা হুনহুনা ধ্বনি ভেসে আসে না।

এক সময়ের “পালকিপাড়া” নামে খ্যাত রাঙ্গুনিয়া উপজেলার শিলক ইউনিয়ন ৬নং ওয়ার্ড নটুয়ারটিলা দাসপাড়া এলাকায় একটি মাত্র অবশিষ্ট জরাজীর্ণ অসংখ্য নববধূ বাহক পালকিটি এখনো ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছেন পরিমল সর্দার।

‘হুনহুনা’ ‘হুনহুনা’ ছন্দের সুরে পালকি নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ৬৫ বছর বয়সী পরিমল সর্দার। কালের বিবর্তনে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন ব্যান্ড পার্টির ঢোলবাদক হিসেবে।

তিনি বলেন, বর্তমান আধুনিক যুগে বিভিন্ন নামিদামি বাহারি গাড়ি দিয়ে বিয়ের বর-কনে বাহনে ব্যবহার হয়, ইভেন্ট কোম্পানি থেকে ভিডিও করতে আসা মানুষরা ভিডিও খাতিরে অ্যাঙ্গেল করতে গিয়ে বরের আগেই নববধূর গায়ের স্পর্শ করে, তখন কিন্তু এই বেহায়াপনা গুলো ছিল না, নববধূকে অতি যত্নে সম্মান ও পর্দা সাথে পালকিতে করে শশুর বাড়িতে বধূবরণ করত।

পরিবারের যে ব্যক্তি সুস্থপুষ্ট যৌবনে গায়ে শক্তি থাকতো, শ্রদ্ধার সাথে বেহারার পেশায় নিয়োজিত হতো, ৫০ থেকে ২ শত টাকার মধ্যে আমাদের পালকি ভাড়া করত। এখন জীবিত অনেকই পেশা ছেড়ে বৃদ্ধ বয়সে কাঠ মিস্ত্রি ও চাষী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করছে। আমি জানি সেই স্বর্ণযুগ গুলো ফিরে আসবে না তবুও কোন অদৃশ্য ইশারাতে যদি পালকি যুগ ফিরে আসে আমাদের মত বেহারারা এই পেশায় সম্মানের সাথে ফিরে আসবে।

তিনি আরো বলেন, রাঙ্গুনিয়ায় এই একটি মাত্র পালকি অবশিষ্ট আছে। এছাড়া রাঙ্গুনিয়ার বাইরে রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী এলাকাতে দ্বিতীয় পালকিটি এখনো আছে বলে ধারণা করছি। যদি প্রশাসন চায় পালকিটি সংরক্ষণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ইতিহাসের স্মৃতি হিসেবে রেখে দিতে পারবে।

রূপালী রাঙ্গুনিয়া পত্রিকার সম্পাদক লেখক ও সাংবাদিক এনায়েতুর রহিম বলেন, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে স্টিমার ও রেলগাড়ি চালু হয়েছে। ১৯৩০-সালে শহরাঞ্চলে রিক্সার প্রচলন হওয়ার পর থেকে পালকির ব্যবহার কমতে থাকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমাগত প্রসার, সড়ক ও নদীপথে মোটর ও অন্যান্য যান জনপ্রিয় হওয়ার ফলে পালকির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।

প্রসঙ্গত, ইতিহাসে পালকির ব্যবহার ঠিক কত বছরের আগে শুরু হয় মাপকাঠিতে তা বলা মুশকিল। তবে, মিসরীয় ও মায়া সভ্যতার চিত্রলিপিতে পালকির ছবি পাওয়া গেছে। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে লেখা বাল্মিকীর রামায়ণেও পালকির কথা এসেছে বহুবার। এছাড়া মোগল আমলেও রাজপরিবারের নারীদের মধ্যে পালকি বেশ জনপ্রিয় ছিল।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পালকি পরিচিত হয়ে আসছে, প্রাচীন রোমে লেটিকা, চীনে জিয়াও, ভিয়েতনামে কিউ, ইংল্যান্ডে সিড্যান চেয়ার, স্পেনে লিটারা, ফ্রান্সে পালানকুইন, পর্তুগালে লিটেইরা, থাইল্যান্ডে ওহ, কোরিয়ায় গামা, জাপানে নোরিমোনো, তুরস্কে টাহটিরেভান।

এ দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও পালকি আছে বিশেষ মর্যাদা নিয়ে। ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর বিখ্যাত ‘পালকির গান’ নামের ছড়ায় তুলে ধরেছেন এ দেশের গাঁয়ের পথে চলা পালকির এক অবিস্মরণীয় চিত্র। পরে এই ছড়াটাই কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে গান হিসেবেও খ্যাতি লাভ করে। পালকি নিয়ে গান গেয়েছেন ভূপেন হাজারিকাও। তাঁর ‘দোলা হে দোলা’ গানটিতে তিনি পালকির বেহারাদের দুঃখভরা জীবনসংগ্রামের করুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতার সেই ছোট্ট ছেলেটির মা-ও চলছিল পালকিতে চড়ে, ‘তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে, দরজাটুকু একটুকু ফাঁক করে।

পৃথিবী বদলে গেছে, রাজাদের রাজত্ব গেছে, গেছে জমিদারের জমিদারিও। রেলগাড়ি, মোটরগাড়ি, রিকশা ইত্যাদি কত রকমের যানবাহন এসেছে। এসব যানবাহনে ধনী-গরিব সবাই চলাচল করতে পারে। বিয়েতেও আজকাল কত রকম বাহারি গাড়ি ব্যবহূত হয়। ইতিহাসের দায় মিটিয়ে তাই হারিয়ে গেছে পালকি। শেষ হয়েছে কাহারদের রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা কষ্টের জীবন। পালকির স্থান এখন ইতিহাসের পাতায়, সিনেমার পর্দায় আর জাদুঘরের শোকেসে।

নিউজটি শেয়ার করুন

ট্যাগস :

রাঙ্গুনিয়ায় অবশিষ্ট ঐতিহ্যবাহী ভ্রমণবাহন ‘পালকি’

আপডেট সময় : ০৫:৩৪:১৯ অপরাহ্ন, বুধবার, ২৫ জানুয়ারী ২০২৩

মুবিন বিন সোলাইমান চট্টগ্রাম:
কালপরিক্রমায় হারিয়ে যাচ্ছে গ্রাম-বাংলার হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যের ভ্রমণবাহন ‘পালকি’। রঙিন ঝালর দেয়া আর নানা রঙের ফুল ও কাগজে সাজানো পালকির ভেতর ঘোমটা দেয়া বধূর মুখখানি দেখতে আশপাশের মানুষ এসে দাঁড়ায় রাস্তার পাশে। এখন আর সেই আবিষ্ট করা হুনহুনা ধ্বনি ভেসে আসে না।

এক সময়ের “পালকিপাড়া” নামে খ্যাত রাঙ্গুনিয়া উপজেলার শিলক ইউনিয়ন ৬নং ওয়ার্ড নটুয়ারটিলা দাসপাড়া এলাকায় একটি মাত্র অবশিষ্ট জরাজীর্ণ অসংখ্য নববধূ বাহক পালকিটি এখনো ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য স্মৃতি হিসেবে রেখে দিয়েছেন পরিমল সর্দার।

‘হুনহুনা’ ‘হুনহুনা’ ছন্দের সুরে পালকি নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে ৬৫ বছর বয়সী পরিমল সর্দার। কালের বিবর্তনে পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছেন ব্যান্ড পার্টির ঢোলবাদক হিসেবে।

তিনি বলেন, বর্তমান আধুনিক যুগে বিভিন্ন নামিদামি বাহারি গাড়ি দিয়ে বিয়ের বর-কনে বাহনে ব্যবহার হয়, ইভেন্ট কোম্পানি থেকে ভিডিও করতে আসা মানুষরা ভিডিও খাতিরে অ্যাঙ্গেল করতে গিয়ে বরের আগেই নববধূর গায়ের স্পর্শ করে, তখন কিন্তু এই বেহায়াপনা গুলো ছিল না, নববধূকে অতি যত্নে সম্মান ও পর্দা সাথে পালকিতে করে শশুর বাড়িতে বধূবরণ করত।

পরিবারের যে ব্যক্তি সুস্থপুষ্ট যৌবনে গায়ে শক্তি থাকতো, শ্রদ্ধার সাথে বেহারার পেশায় নিয়োজিত হতো, ৫০ থেকে ২ শত টাকার মধ্যে আমাদের পালকি ভাড়া করত। এখন জীবিত অনেকই পেশা ছেড়ে বৃদ্ধ বয়সে কাঠ মিস্ত্রি ও চাষী হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করছে। আমি জানি সেই স্বর্ণযুগ গুলো ফিরে আসবে না তবুও কোন অদৃশ্য ইশারাতে যদি পালকি যুগ ফিরে আসে আমাদের মত বেহারারা এই পেশায় সম্মানের সাথে ফিরে আসবে।

তিনি আরো বলেন, রাঙ্গুনিয়ায় এই একটি মাত্র পালকি অবশিষ্ট আছে। এছাড়া রাঙ্গুনিয়ার বাইরে রাউজান উপজেলার পাহাড়তলী এলাকাতে দ্বিতীয় পালকিটি এখনো আছে বলে ধারণা করছি। যদি প্রশাসন চায় পালকিটি সংরক্ষণ করে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য ইতিহাসের স্মৃতি হিসেবে রেখে দিতে পারবে।

রূপালী রাঙ্গুনিয়া পত্রিকার সম্পাদক লেখক ও সাংবাদিক এনায়েতুর রহিম বলেন, উনিশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে যাতায়াতের মাধ্যম হিসেবে স্টিমার ও রেলগাড়ি চালু হয়েছে। ১৯৩০-সালে শহরাঞ্চলে রিক্সার প্রচলন হওয়ার পর থেকে পালকির ব্যবহার কমতে থাকে। যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমাগত প্রসার, সড়ক ও নদীপথে মোটর ও অন্যান্য যান জনপ্রিয় হওয়ার ফলে পালকির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়।

প্রসঙ্গত, ইতিহাসে পালকির ব্যবহার ঠিক কত বছরের আগে শুরু হয় মাপকাঠিতে তা বলা মুশকিল। তবে, মিসরীয় ও মায়া সভ্যতার চিত্রলিপিতে পালকির ছবি পাওয়া গেছে। প্রায় আড়াই হাজার বছর আগে লেখা বাল্মিকীর রামায়ণেও পালকির কথা এসেছে বহুবার। এছাড়া মোগল আমলেও রাজপরিবারের নারীদের মধ্যে পালকি বেশ জনপ্রিয় ছিল।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে পালকি পরিচিত হয়ে আসছে, প্রাচীন রোমে লেটিকা, চীনে জিয়াও, ভিয়েতনামে কিউ, ইংল্যান্ডে সিড্যান চেয়ার, স্পেনে লিটারা, ফ্রান্সে পালানকুইন, পর্তুগালে লিটেইরা, থাইল্যান্ডে ওহ, কোরিয়ায় গামা, জাপানে নোরিমোনো, তুরস্কে টাহটিরেভান।

এ দেশের সাহিত্য-সংস্কৃতিতেও পালকি আছে বিশেষ মর্যাদা নিয়ে। ছন্দের জাদুকর সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর বিখ্যাত ‘পালকির গান’ নামের ছড়ায় তুলে ধরেছেন এ দেশের গাঁয়ের পথে চলা পালকির এক অবিস্মরণীয় চিত্র। পরে এই ছড়াটাই কিংবদন্তি কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে গান হিসেবেও খ্যাতি লাভ করে। পালকি নিয়ে গান গেয়েছেন ভূপেন হাজারিকাও। তাঁর ‘দোলা হে দোলা’ গানটিতে তিনি পালকির বেহারাদের দুঃখভরা জীবনসংগ্রামের করুণ চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। রবীন্দ্রনাথের ‘বীরপুরুষ’ কবিতার সেই ছোট্ট ছেলেটির মা-ও চলছিল পালকিতে চড়ে, ‘তুমি যাচ্ছ পালকিতে মা চড়ে, দরজাটুকু একটুকু ফাঁক করে।

পৃথিবী বদলে গেছে, রাজাদের রাজত্ব গেছে, গেছে জমিদারের জমিদারিও। রেলগাড়ি, মোটরগাড়ি, রিকশা ইত্যাদি কত রকমের যানবাহন এসেছে। এসব যানবাহনে ধনী-গরিব সবাই চলাচল করতে পারে। বিয়েতেও আজকাল কত রকম বাহারি গাড়ি ব্যবহূত হয়। ইতিহাসের দায় মিটিয়ে তাই হারিয়ে গেছে পালকি। শেষ হয়েছে কাহারদের রোদে পোড়া, বৃষ্টিতে ভেজা কষ্টের জীবন। পালকির স্থান এখন ইতিহাসের পাতায়, সিনেমার পর্দায় আর জাদুঘরের শোকেসে।