নওগাঁ দেখা মিলল প্রাচীন শিক্ষা নগরীর ধ্বংসাবশেষ
- আপডেট সময় : ০২:৪৬:৩৫ অপরাহ্ন, সোমবার, ২৩ জানুয়ারী ২০২৩ ২০২ বার পড়া হয়েছে
মোঃ এ কে নোমান,বিশেষ প্রতিনিধিঃ
নওগাঁর ধামইরহাট উপজেলার আলমপুর উনিয়নের উত্তর সীমান্তে আত্রাই নদীর পূর্ব কোলঘেষে মাহিসন্তোষে দেখা মিলল পাল আমল ও সুলতানী আমলে গড়েওঠা শিক্ষা নগরীর।
শনিবার (২১ জানুয়ারী) সকালে সরজমিনে গিয়ে দেখা গেছে মাহিসন্তোষে অবস্থিত প্রাচীন কালের শিক্ষা নগরীর বিলুপ্ত মসজিদ ও মাদ্রাসার মূল ভিত্তির। এ ছাড়াও দেখা মিললো ধ্বংসাবশেষের আসে পাসে ছরিয়ে ছিটকে থাকা পাথরের খণ্ডচিত্র।
এসময় উপস্থিত ছিলেন বরেন্দ্রভূমির ইতিহাস ঐতিহ্য বিষয়ে গবেষক ও লেখক প্রভাষক মো. আব্দুর রাজ্জাক (রাজু), সিনিয়র সাংবাদিক মো. আব্দুল মালেক, প্রভাষক মো.ইউনুস আলী (ইমন), শিক্ষক মো. জাহাঙ্গীর আলম, সুদক্ষ ফটোগ্ৰাফার সহকারী কাম কম্পিউটার মো. আবু বকর সিদ্দিক (নয়ন)।
ইতিহাস অনুসন্ধানী গবেষক প্রভাষক মো. আব্দুর রাজ্জাক (রাজু) বলেন, মাহিসন্তোষ একটি প্রাচীন শিক্ষা নগরীটি কালের বিবর্তনে বিলুপ্ত হয়েছে। এটি বাংলাদেশের তথা আমাদের নওগাঁ জেলার খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এই প্রাচীনতম শিক্ষা নগর টিকে সরকারি ভাবে খননের মাধ্যমে উদ্ধার করে দর্শনার্থীদের জন্য উন্মুক্ত করে দিলে আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে আমাদের ফেলে আসা হাজার বছরের প্রাচীন সভ্যতা, শিক্ষা ও সংস্কৃতির পরিচয় অবমুক্ত হবে।
বঙ্গে ইসলাম প্রচারের প্রথম পর্বে বা মুসলিম যুগে মসজিদগুলি ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতি বিকাশে বিশেষ ভূমিকা পালন করতো। মসজিদে মক্তব স্থাপন করে মুসলমান শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষা দানের ব্যবস্থা করা হতো। কোরআন ও হাদীসের প্রাথমিক পাঠ এবং আরবি ও ফারসি ভাষার হাতেখড়ি হত মক্তবেই। মাহি সন্তোষের মসজিদগুলো (যে চারটি মসজিদের শিলালিপি পাওয়া যায়) শিক্ষা বিস্তারে যে একই ধরনের ভূমিকা রাখে তাতে কোন সন্দেহ নেই। (মিনহাজ ই সিরাজ ও তাবাকাতে নাসিরি পৃঃ ৪৮) অবশ্য এর পরবর্তী যুগেও শিক্ষা বিস্তারের প্রধান কেন্দ্র ছিল মাদ্রাসা। বাংলায় ক্ষমতা বিস্তারের অব্যাহতি পূর্বে মুসলমানরা বিভিন্ন স্থানে তিনটি মাদ্রাসা নির্মাণ করেন। ঐতিহাসিকদের মতে খলজি মালিকরা তিনটি প্রসিদ্ধ স্হানে (ক)দেবকোট (খ) নরকুটি (গ) মাহিসন্তোষে তিনটি মাদ্রাসা স্থাপন করেন। (ড,রেজাউল ইসলাম- মাহিসন্তোষ, পৃঃ১১০)।
সুলতান আলাউদ্দিন হোসেন শাহ (১৪৯৩-১৫১৯)এর আগে প্রখ্যাত আলেম হযরত তাকিউদ্দীন আল আরাবি মাহিশুনে একটি মাদ্রাসা স্হাপন করেন। বিহারের বিখ্যাত পীর ইয়াহিয়া মানেরী ও তার পুত্র শরফুদ্দী মানেরী মাহিশুনে আরবি, ফার্সি, ও আদ্ধাতিক শিক্ষা গ্রহণ করেন। শরফুদ্দীন মানেরীর জামাতা সোনার গাঁয়ের শরফুদ্দীন আবু তৈয়ামিয়া বিক্ষ্যাত আলেম ছিলেন।বিভিন্ন ঐতিহাসিকদের মতে ত্রয়োদশ শতকের মাঝামাঝি সময়ে মাহিশুন মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়। মাহিশন্তোষের বিস্তৃর্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ঢিবি সমুহের কোন একটি হয়তো এই মাদ্রাসার ধংসাবশেষ হয়ে থাকবে।(কাজী মিছের-রাজশাহী জেলার ইতিহাস)।
মাদ্রাসায় পঠিত বিষয় সমুহের মধ্যে (ক) আল কোরআন (খ) আল হাদীস (গ) আল ফিকাহ (ঘ) আরবি (ঙ) ফার্সি (চ) বাংলা, প্রভৃতি ধর্ম, সাহিত্য ও শাস্ত্রগত জ্ঞান পড়ানো হতো। এছাড়া (ছ) ধনবিদ্যা (জ) জ্যোতি বিদ্যা (ঝ) শরীরতত্ববিদ্যা প্রভৃতি বিজ্ঞান, লিখন ও হস্ত শিল্পের মত চারুকলার বিষয়ে সেই আমলের মাদ্রাসা সমুহে পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত ছিলো বলে পন্ডিত গন মনে করেন। অবশ্য মাদ্রাসায় এর বাইরেও অনেক বিষয় পড়ানো হতো। (আ,ক,ম,জাকারিয়া-মুসলিম- স্থাপত্য)।
মুঘল ঐতিহাসিক আবুল ফজল তার গ্রন্থেও একি কথা লিখেছেন। তবে তিনি লিখেন শিক্ষার্থীদের জন্য এত গুলো বিষয় আবশ্যিক ছিলনা। অনেকটা আধুনিক যুগের মতই পাঠদান ব্যবস্হা এ-সময় মাহিশুন মাদ্রাসায় ছিল। এই প্রসিদ্ধ মাদ্রাসায় ছাত্রভেদে সবগুলো বিষয়ে পড়ানোর ব্যবস্হা ছিলো ( মুঘল ঐতিহাসিক আবুল ফজল)।
মাহিসুন মাদ্রাসা ছিল একটি বৃহত্তর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। মাদ্রাসায় পাঠদানের জন্য বর্তমান ভারতের একডালা থেকে একজন মোহাদ্দেস আনা হয়।তার নাম মোহাম্মদ বীন ইয়াযদান বক্স।তিনি এখানে বোখারী শরীফের তিনটি খন্ড অনুবাদ করেন। এছাড়াও এখানে, “নাম-ই-হক” নামক ফার্সি ভাষার রচিত একটি ফেকাহ গ্রন্থের সন্ধান পাওয়া যায়।
তখন ভালো চাকরি পেতে ফার্সিভাষা জানতে হতো। এসময় খোদাইকৃত শিলালিপি সমুহের প্রায় সবগুলো ফার্সি ও আরবি ভাষায় রচিত। ১৬ শতকের চৈনিক পরিব্রাজকদের বিবরণ থেকে এখানকার অভিজাত সভাসদ গনের কথা বার্তায় ফার্সি ভাষার দক্ষতার প্রমান পাওয়া যায়।
সুলতান আলাউদ্দীন হোসেন শাহ(১৪৯৩-১৫১৯) এর আমলে মাদ্রাসার মোহতামিম সৈয়দ মীর আলাভী এখানে “হেদায়েত -ই-রামি” শীর্ষক ধনু বিদ্যার বিখ্যাত গ্রন্থ সংকলন করেন। মুসলিম আমলের লিপি সমুহের সুন্দর রচনাশৈলী অবলোকন করে অনেক গবেষক মনে করেন এ যুগের বারবাকাবাদের এই মাদরাসা সহ অন্যান মাদ্রাসা সমুহে তখন ক্যালিওগ্রাফির অধ্যয়ন হতো। (মোঃ খোশবর আলী)।
তাইত মধ্যযুগের সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চায় বহুমুখী মাদ্রাসাটি মাহিশন্তোষ তথা বারবাকাবাদ পরগনার প্রানকেন্দ্রে হওয়াই এই শহরটি অত্র অঞ্চলের মধ্যে শিক্ষা নগরীতে পরিনত হয়েছিল। (আব্দুল করিম)। এলাকা বাসীর দাবী- উর্ধতন কর্তৃপক্ষ মাহিসন্তোষে হযরত তকিউদ্দীন আল আরাবী প্রতিষ্ঠিত মাদ্রাসাটি পুনরায় চালু করলে জাতি তার প্রাচীন পরিচয় খুজে পাবে।